অতিরিক্ত প্রশংসা বা তোষামোদ ইসলামে শুধু নিষিদ্ধই করা হয়নি বরং পরকালে তোষামোদকারীকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে মহান আলস্নাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমে এরশাদ করেন, ‘তুমি মনে করো না- তারা শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে; যারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আনন্দিত হয় এবং না করা বিষয়ের জন্য প্রশংসিত হতে ভালোবাসে। এরূপ কখনো মনে করো না, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১৮৮)
সুতরাং কারও প্রশংসা করতে গিয়ে অতিরঞ্জিত না করাই ইসলামের বিধান। কেননা অতিরক্তি প্রশংসা ও তোষামোদের দ্বিমুখী ক্ষতি রয়েছে। যে ব্যক্তি প্রশংসা করে আর যার প্রশংসা করা হয়, উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তোষামোদকারীদের সম্পর্কে সতর্ক করে ইসলামে বলা হয়েছে, তোষামোদকারীরা শুধু নির্লজ্জই নয়, তারা অযোগ্যও বটে। সাধারণত অযোগ্য এবং অকর্মণ্য ব্যক্তিরাই কিছু পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের তোষামোদ করে। মন্দ দিকগুলো এড়িয়ে, শুধু অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে তাদের নৈকট্য হাসিলের ঘৃণ্য প্রয়াসে লিপ্ত থাকে। এদের ব্যাপারে এক হাদিসে আলস্নাহর রাসুল (সা.) বলেন- ‘দুর্বল ইমানের পরিচয় হলো,
পার্থিব ধন-সম্পদের লোভে অন্যের অবাস্তব প্রশংসা করা বা তোষামোদ করা।’ এতে তোষামোদকৃত ব্যক্তি তুষ্ট হলেও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
তোষামোদের কুফল বা ক্ষতির দিকগুলো আলোচনা করতে গিয়ে হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তার এক গ্রন্থে উলেস্নখ করেন- অবাস্তব প্রশংসা বা তোষামোদ পাঁচটি ক্ষতি বয়ে আনে। তন্মধ্যে তোষামোদকারী ব্যক্তি তিনটি ক্ষতির সম্মুখীন হয় আর তোষামোদকৃত ব্যক্তি সম্মুখীন হয় দুটি ক্ষতির। তোষামোদকারী ব্যক্তি যে তিনটি ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হলো- এক. তোষামোদ করার মাধ্যমে তোষামোদকারী ব্যক্তি মূলত মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে থাকে। দুই. তোষামোদকারী ব্যক্তি তোষামোদের মাধ্যমে মুনাফেকি বা কপটতার শিকার হয়। তিন. অন্যকে গোনাহে লিপ্ত করার ক্ষতি। কারণ, তোষামোদকৃত ব্যক্তি তোষামোদকারীর অতিরিক্ত প্রশংসা শুনে নিজেকে বড় ও যোগ্য মনে করে। অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকে। আর এগুলোর দায় বা গুনাহ মূলত তোষামোদকারী ব্যক্তির উপর বর্তায়।
ইসলাম মনে করে, তোষামোদ মূলত মানুষের যোগ্যতাকে বিনষ্ট করে। কারণ, মানুষ যখন যোগ্যতা প্রদর্শন ছাড়াই প্রশংসা ও স্তুতি শুনতে পায় তখন মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে আগ্রহী হয় না। ফলে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকে। আর আত্মতৃপ্তি ও আত্মতুষ্টি মানুষের শুধু উন্নতি ও অগ্রগতিকেই ব্যাহত করে তা নয়, বরং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবনতিকেও ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে তোষামোদের আধিক্যের কারণে জাতীয় জীবনে আত্মসম্মান ও আত্মপরিচয় বোধের অভাব দেখা দেয়।
তোষামোদ করা প্রকারান্তে মুনাফেকি বলেও ইসলামে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। আর মুনাফিকের সাজা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সবচে নিম্নস্তরে থাকবে।’ (সুরা নিসা : ১৪৫)
অন্যদিকে তোষামোদকৃত ব্যক্তি অতিরিক্ত প্রশংসা শুনে আত্মম্ভরিতার শিকার হয়ে যায়। ফলে অন্তরে জন্ম নেয় অহংকার ও অহমিকার সর্বনাশা ব্যাধি। যা তার সব সদগুণকে ধ্বংস করে দেয়। আর অহংকারী ও দাম্ভিককে আলস্নাহ তায়ালা অপছন্দ করেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারিমে আলস্নাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আলস্নাহ তায়ালা অহংকারী ও দাম্ভিক ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লুকমান : ১৮)
পবিত্র কোরআনে অবাস্তব প্রশংসা বা তোষামোদকে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সুরা তাওবায় আলস্নাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘ইহুদিরা বলে, আমাদের রাসুল উজাইর হলেন আলস্নাহর পুত্র। আর খ্রিষ্টানরা বলে, আমাদের রাসুল ইসা মাসিহ হলেন আলস্নাহ তায়ালার পুত্র। এগুলো মূলত তাদের মুখের অতু্যক্তি।’ (সুরা তাওবা : ৩০)
এই আয়াতের সমর্থনে সহিহ বুখারির এক হাদিসে আলস্নাহর রাসুল (সা.) এই ধরনের প্রশংসা বা তোষামোদকে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের স্বভাব আখ্যা দিয়ে ঘোষণা করেন- ইহুদি খ্রিষ্টানরা যেভাবে তাদের রাসুলদের অবাস্তব প্রশংসা করেছে তোমরা আমার ক্ষেত্রে এমন বাড়াবাড়ি বা তোষামোদি করো না।
বহু হাদিসেও আলস্নাহর রাসুল (সা.) অবাস্তব প্রশংসা বা তোষামোদকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। সহিহ মুসলিমের এক হাদিসে আলস্নাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন তোমরা তোষামোদকারীদের সম্মুখীন হবে তখন তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করো।’